বাংলাদেশে যে ১০টি মানসিক সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে বেশি যায় মানুষ

 

  • জান্নাতুল তানভী
  • Role,বিবিসি নিউজ বাংলা

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণভাবে দেখা যায়, যিনি এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তার নিজের মধ্যেও এক ধরনের ‘স্টিগমা’ কাজ করে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সস্টিটিউটের ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ মানুষ কোন না কোন মানসিক রোগে আক্রান্ত।

এর মধ্যে শুধু এক শতাংশ মানুষ জটিল মানসিক রোগে আক্রান্ত বলে বলছেন চিকিৎসক এবং মনোবিদেরা।



চিকিৎসক এবং মনোবিদেরা বলছেন, ক্রমে বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটু একটু করে সচেতনতা বাড়ছে, এবং আগের তুলনায় বেশি মানুষ সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

যদিও মানসিক সমস্যা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে এমন ভ্রান্ত ধারণা থেকে মনোচিকিৎসকের কাছে যায় না বেশিরভাগ মানুষ।

এবং সে সমস্যার শারীরিক উপসর্গ দেখা দিলে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নেন অধিকাংশ মানুষ।

কিন্তু বাংলাদেশে ঠিক কী কী সমস্যা নিয়ে মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন?

বিবিসি বাংলা এ নিয়ে মনোচিকিৎসক মোহিত কামাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ডা. মেখলা সরকার এবং সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. মো. ফারুক হোসেনের সাথে কথা বলেছে - তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

আরো পড়ুন

'image.png' failed to upload.

যেসব সমস্যা নিয়ে বেশি আসেন মানুষ

মোহিত কামাল, ডা. মেখলা সরকার এবং ডা. মো. ফারুক হোসেন - তিনজন বিশেষজ্ঞই বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সাধারণত উদ্বেগ-জনিত মানসিক রোগ, বিষন্নতাবোধ এবং শুচিবায়ু সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে মানুষ তাদের শরণাপন্ন হন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন না কোনো শারীরিক উপসর্গ নিয়ে রোগীরা আসেন। বিষণ্ণতা বা উদ্বেগ যে কোন মানসিক সমস্যা বা তার কারণ - এ নিয়ে সচেতনতা নেই বেশিরভাগের।

বাংলাদেশে যে ১০টি মানসিক সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে বেশি যায় মানুষ সেগুলো নিম্নরূপ:

বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার

বিষণ্ণতাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে শুরুতেই এর প্রতি যথাযথ দৃষ্টি না দিলে এ থেকে গুরুতর সমস্যা তৈরি হতে পারে।

মনোচিকিৎসকরা বলছেন, বিষণ্ণতায় আক্রান্তদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়ে থাকে।

যদিও বিষণ্ণতা বলতে অনেকে মন খারাপকে বুঝে থাকেন।

কিন্তু চিকিৎসকরা জানান, যদি দীর্ঘমেয়াদে যেমন দুই সপ্তাহ টানা মন খারাপ থাকলে, অথবা যেসব কাজে আগে আনন্দ লাগতো তাতে আর আনন্দ না পাওয়ার মতো হলে এটিকে বিষণ্ণতার লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

মনোবিদ ডা: মেখলা সরকার বলেছেন, বিষণ্ণতা মানুষের মনের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

একজন মানুষের কোনো বিষয়ে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া বা এ ধরণের নানা কারণে মন বিষণ্ণ হতেই পারে।

এ রোগ হলে যেসব শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয় সেগুলো হল:

  • ১. রোগী শারীরিকভাবে খুব দুর্বল বোধ করতে পারে।
  • ২. ঘুমের সমস্যা এ রোগের অন্যতম উপসর্গ। রাতে ঘুম না হওয়া বা ঘুমের যে তৃপ্তি সেই বোধ না হওয়া।
  • ৩. শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা ,মাথাব্যথা হতে পারে।
  • ৪. পেটের সমস্যা হতে পারে।
  • ৫. হাত-পা জ্বালাপোড়া করা।
  • ৬. অস্থিরতা বোধ করে রোগী।

চিকিৎসকরা বলছেন, এসব শারীরিক উপসর্গ বৃদ্ধি পেলেই মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হন রোগী।

'image.png' failed to upload.

উদ্বেগ-জনিত রোগ বা প্যানিক ডিজঅর্ডার

এ রোগে সবচেয়ে সাধারণ যে বিষয়টি রোগীর হয় তা হলো প্যানিক অ্যাটাক। মনোচিকিৎসকরা জানান, প্যানিক অ্যাটাক হলে হয়তোবা পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে উপসর্গ তীব্র হয়।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়ার পর দেখা যায় রোগী শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ।

যে শারীরিক উপসর্গগুলো এ রোগে দেখা দেয় সেগুলো হল:

  • ১. হঠাৎ করে বুক ধড়ফড় করা বা বুকে সাংঘাতিক রকমের চাপ লাগা। বুকে ব্যথা হয় এমন অনুভূতি হয়, মনে হবে এখনই স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হবে।
  • ২. রোগীর শ্বাসকষ্ট হয়। এটি এ রোগের অন্যতম লক্ষণ। এতে মনে হবে রোগী দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে।
  • ৩. ভীতিমূলক চিন্তা, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
  • ৪. ঘন ঘন ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া।
  • ৫. রোগী দুঃস্বপ্ন দেখে।

'image.png' failed to upload.
এ রোগে রোগী যেসব মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হন সেগুলো হলো সে সবসময় সবকিছুতে উদ্বেগ বোধ করে।

জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার

এ সমস্যায় রোগী সবসময় সবকিছুতে উদ্বেগ বোধ করে। ছোটখাট সবকিছুতে আশঙ্কা হয় রোগীর। টেনশন এ রোগীর নিত্যসঙ্গী।

মনোচিকিৎসকরা জানান, রোগী সবসময় অস্থির বোধ করে, মেজাজ খিটখিটে থাকে। কাজে মনোযোগ কম থাকে এবং ভুলে যায়।

এ রোগে রোগীর মনে হবে সে সবকিছু ভুলে যাচ্ছে, আগের মত মনে রাখতে পারছে না।

এ রোগে যেসব শারীরিক সমস্যা হয় সেগুলো হলো:

  • রোগী খুব দুর্বল অনুভব করে ও ক্লান্ত বোধ করে।
  • বুক ধড়ফড় করবে কিন্তু প্যানিক অ্যাটাকের মত অত তীব্র হবে না।
  • মাঝে মাঝে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় রোগীর।
  • পেটে চাপ অনুভব করে, খাবার হজম হয় না ঠিকমতো।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য হয় এ রোগে আক্রান্ত হলে।

মনোচিকিৎসক ডা. মেখলা সরকার বলেন, যখন কেউ জেনারালাইজড এংজাইটি ডিজঅর্ডারে ভোগে তখন তার ব্রেইন কিছুটা রিঅ্যাক্ট করে।

“নিউরো কেমিক্যালসগুলা শরীরের যে নানা রকমের সিস্টেম আছে, আমাদের যেমন হার্টের সিস্টেম, নিঃশ্বাসের প্রক্রিয়া এটাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। যার কারণে শারীরিক নানা উপসর্গ হতে পারে।”


ব্যক্তিত্ব-জনিত ত্রুটি বা পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার

এ ধরনের রোগীরা নিজেকে আঘাত করে যে কোন ঘটনা ঘটায়।

ব্যক্তিত্ব-জনিত ত্রুটি থাকলে হঠাৎ করে ব্যক্তি নিজের হাত কেটে ফেলে, আত্মহত্যার চেষ্টা করা, হঠাৎ করে ঘুমের ওষুধ খাওয়াসহ নানাভাবে নিজেকে আঘাত করার মানসিকতা থাকে।

মিজ সরকার বলেন, “যাদের নানা রকমের ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব থাকে এদেরও কো-মরবিডলি ডিপ্রেশন ও অ্যাঙজাইটি থাকে। কিন্তু তাদের বেসিক ডায়াগনোসিস থাকে পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার।”

ফোবিক ডিজঅর্ডার

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা একা একা দূরে কোথাও যেতে ভয় পায়। গণ-পরিবহনে উঠতে অসুবিধা হয় এ ধরনের রোগীদের।

তারা অহেতুক ভীতিতে ভোগেন। কোলাহলময় জায়গায় যেতে ভয় পান ফোবিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীরা।

মনোচিকিৎসকরা জানান, এ ধরনের ফোবিয়াকে এগোরা ফোবিয়া বলে। উঁচু জায়গায় উঠতে ভয় পান এ ধরনের রোগীরা। প্লেনে উঠতে চান না।

যেখান থেকে সহজে তারা মুভ করতে পারবেন না, এমন স্থান তারা পরিহার করেন।

এমনকি কোন বদ্ধ জায়গা, যেমন ট্রাফিক জ্যাম - যা সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এমন স্থানে ভীতিতে ভোগেন এ ধরনের ফোবিক ডিজঅর্ডারের রোগীরা। নিজেরা যে স্থানে নিরাপদ বোধ করেন না সে স্থানে যেতে চান না তারা।

অন্য সব লাইফ-স্টাইল ঠিক থাকলেও এ ভীতির কারণে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় পরিহার করেন এ ধরনের রোগীরা।


এডিএইচডি বা অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার

শিশু-কিশোরদেরও মানসিক রোগ হতে পারে। তারা এই এডিএইচডি রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

এ রোগের কারণে শিশুরা অতিরিক্ত চঞ্চল, মনোযোগের অভাব এবং অতিরিক্ত দুষ্টামি করে বলে জানান মনোচিকিৎসকরা।

শিশু-কিশোরদের মানসিক রোগের মধ্যে স্কুল ভীতি, স্কুল পালানো, আচরণগত সমস্যা, অটিজম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, ঘুমের সমস্যা, খাদ্যগত সমস্যা প্রধান।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের করা মানসিক রোগের চিকিৎসায় ফ্যামিলি গাইড বইয়ে বলা হয়েছে, শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যাগুলোর পেছনে পারিবারিক কারণ, সামাজিক কারণ এবং জন্মকালীন মাথায় আঘাতই প্রধান কারণ।

বর্তমান যুগে বাচ্চাদের তীব্র মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তি থেকেও মানসিক রোগ হয় বলে জানান মনোবিদরা।

এর ফলে বাচ্চারা জেদি হয়ে উঠে যা তার সামাজিক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এক্ষেত্রে বাবা-মার কিছু ভুল আচরণও বিষয়টিকে আরো জোরালো করে বলে জানান চিকিৎসকরা।