১৫ বর্গফুটের ঘর, ছয়জনের দল, আর এক তরুণের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন

 

ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর দক্ষিণের এক নির্জন গ্রাম—পুঁইছড়ি ইউনিয়ন। এখানেই ছয় কক্ষের একটি একতলা ঘরের পেছনের মাত্র ১৫ বর্গফুটের এক কোণায় গড়ে উঠেছে এক অনন্য প্রযুক্তি ল্যাব এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ল্যাব’। আর এই ল্যাবের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন একজন স্বপ্নবাজ তরুণ আশির উদ্দিন।

সব শুরু হয়েছিল ছাদে বসে মোটরের সাহায্যে খেলনা নৌকা বানাতে গিয়ে। হঠাৎ চোখে পড়ে, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটি বিশাল যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ। তখনই মাথায় প্রশ্ন—“এমন কিছু কি আমিও বানাতে পারি?” সেই ভাবনা থেকেই শুরু হয় যাত্রা, যা পরে রূপ নেয় ড্রোন ও উড়োজাহাজ উদ্ভাবনের সাহসী এক অভিযাত্রায়।

২০১৬ সাল থেকে আশির উদ্দিন তৈরি করেছেন ৬০০টির বেশি উড়োজাহাজ মডেল এবং ২০টিরও বেশি কার্যকর ড্রোন। তার তৈরি ১০টি ড্রোন সফলভাবে উড়তে ও অবতরণ করতে পেরেছে, যা বাংলাদেশি উদ্ভাবনী শক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

ড্রোন তৈরির পেছনে আছে ছয় সদস্যের নিবেদিত একটি টিম। তারা একসাথে কাজ করে ডিজাইন, ইলেকট্রনিক সংযোগ, সেন্সর বসানো, সফটওয়্যার কনফিগারেশন ও ফ্লাইট টেস্ট সম্পন্ন করে। একেকটি ড্রোন তৈরি করতে লাগে প্রায় ১০ থেকে ১৫ দিন। প্রতিটি ড্রোনের ওজন ১০–২০ কেজির মধ্যে এবং বাজারমূল্য প্রায় ৩–৬ লাখ টাকা। এগুলো শুধুমাত্র শখের জিনিস নয়—ব্যবহার করা যায় গোয়েন্দা নজরদারি, সীমান্ত নিরাপত্তা ও এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও।

প্রথমদিকে আশিরের এই পথচলা ছিল সম্পূর্ণ নিজের জমানো অর্থে। পরবর্তীতে নিজের কাজের ভিডিও তৈরি করে তিনি তা পোস্ট করতে থাকেন ইউটিউব ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এখান থেকেই শুরু হয় তার আরেকটি আয়ের পথ। বর্তমানে তিনি ড্রোন বিক্রির পাশাপাশি ভিডিও কনটেন্ট থেকেই ল্যাব চালানোর খরচ ও নিজের সংসারের ব্যয় বহন করছেন।

আশির বলেন,

আমি শুধু ইনকাম নয়, মানুষের আগ্রহ জাগাতে চাই। অনেক তরুণ আমার ভিডিও দেখে প্রযুক্তি নিয়ে জানতে চায়, শিখতে চায়। আমি তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করি।”

আশির উদ্দিনের কাজ ইতোমধ্যে সম্মান পেয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। তারা তাঁকে উদ্ভাবনী দক্ষতার জন্য সম্মাননা প্রদান করেছে। পাশাপাশি, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দেড় বছরের জন্য এভিয়েশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়—যেখানে তিনি শিখেছেন এয়ারক্রাফট ডিজাইন, এয়ারোডাইনামিক্স ও সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন।

এখন আশিরের স্বপ্ন একটি পূর্ণাঙ্গ ড্রোন নির্মাণ প্ল্যান্ট গড়ে তোলা, যেখানে ১০–১৫ জন প্রকৌশলী ও কারিগর কাজ করবেন। সেই স্বপ্নের অংশ হিসেবে তিনি চান সরকারি সহায়তা, অনুদান এবং তার গ্রামে একটি প্রযুক্তি হাব স্থাপন।

আশির উদ্দিন এখন কেবল একজন উদ্ভাবক নন—তিনি হয়ে উঠেছেন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা বাংলাদেশের সম্ভাবনার প্রতীক। তার গল্প প্রমাণ করে—প্রযুক্তি শুধু শহরে নয়, গ্রামেও বেড়ে ওঠে। সীমিত পরিসরেও বড় স্বপ্ন বাঁচে, যদি তাতে থাকে অদম্য চেষ্টা, নিষ্ঠা আর বিশ্বাস।

প্রশ্ন এখন—এই গতি, এই গবেষণা, এই স্বপ্ন—আমরা কি ধরে রাখতে পারব?

Post a Comment

0 Comments